ফাতিউস ফাহমিদ
১৯৪৭, সময় তখন উত্তাল। ধর্ম-জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গেল উপমহাদেশ। পাক-ভারতের রাজনীতিতে তখন উত্থান-পতনের খেলা। পাকিস্তানের রাজনীতি তখন আরো উত্তাল। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মাতোয়ারা সবাই। স্বাধীনতা তো মিলল, স্বরাজ মিলবে তো? নাক উচু পশ্চিম পাকিস্তানিরা খর্বকায় পূর্ব পাকিস্তানিদের মেনে নেবে তো? ধর্মের ভিত্তিতে যে স্বাধীনতা এলো সেটার মান থাকবে তো?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন উঠতি নেতা। চোখে স্বাধীকারের স্বপ্ন, কণ্ঠে দীপ্ত স্লোগান। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা সন্তান সম্ভবা। ২৮ সেপ্টেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় শেখ হাসিনার যেদিন জন্ম বঙ্গবন্ধু সেদিন কলকাতায় ছিলেন। সন্তান জন্মের খবর পেয়েই ছুটে এলেন বাসায়। দেখতে অসম্ভব সুন্দর হওয়ায় দাদা শেখ লুৎফর রহমান নাতনির নাম রাখেন ‘হাসিনা’।
১৯৫২ সালে বাবার হাত ধরে ঢাকায় আসেন শেখ হাসিনা। রাজনীতি ও মানবসেবায় ব্যস্ত থাকায় বাবাকে খুব একটা কাছে পাননি। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় তার দায়িত্বও ছিল অনেক বেশি। পড়াশোনার পাশাপাশি মায়ের সাথে সংসারের বিভিন্ন দিক সামলেছেন নিপুণভাবে। আরমানিটোর ৮/৩, রজনীবোস লেনের বাড়ি ছেড়ে ১৯৫৪ সালে মিন্টু রোডের সরকারি বাসায় উঠলেন মুজিব পরিবারের। বঙ্গবন্ধু তখন মন্ত্রী। মিন্টুরোডের বাসা ছেড়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৮ সালে সেগুনবাগিচার বাসায় উঠলেন।
বাবাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে দেখেই বড় হয়েছেন শেখ হাসিনা। দেখেছেন রাজনৈতিক উত্থান-পতন। মন্ত্রীর মেয়ে হয়েও শেখ হাসিনার আচরণে আসেনি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন। ছোট থেকেই হাসিনা সবার প্রিয়। বুকে কষ্ট চেপে, চোখের পানি রেখে মায়ের চোখের জল মুছেছেন। ভাই-বোনদের আগলে রেখেছেন পরম মমতায়।
সবে মাত্র কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। ১৯৬৭ সালে অনেকটা নাটকীয়ভাবে বিয়ে হলো এমএ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে। বাবা তখন জেলে। বিয়ের পর জেল গেটে গিয়ে বাবার দোয়া নিয়ে আসেন নব দম্পতি। এরপর শেখ হাসিনা পুরোদস্তুর গৃহিনী। মন্ত্রী বা এক সময় হয়ে উঠলেন আপামর বাংলার নেতা। জেলে বসেই দেশকে এনে দিলেন স্বাধীনতা।
সবকিছু ঠিকই চলছিল। স্বামীর সাথে বিদেশে পাড়ি জমালেন শেখ হাসিনা। আর দশজন বাঙালি মায়ের মতো সামলাচ্ছিলেন নিজ সংসার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বদলে গেল সবকিছু। একরাতেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল। উলটপালট হয়ে গেল শেখ হাসিনার সাজানো জীবন। বাবা-মা-পরিবার হারানোর খবর পেলেন প্রবাসে বসে। তাদের চোখের শেষ দেখাটাও দেখতে পেলেন না।
১৯৮১ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি তখন চরম উত্তপ্ত। নেই নুন্যতম মানবাধিকার, গণতন্ত্র পথে পথে ভুলুণ্ঠিত। জাতির পিতার হত্যাকারীদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে। ১৫ আগস্টের হায়েনারা তখন রাষ্ট্র-ক্ষমতায়। বাবার ঘামে-রক্তে স্বাধীন হওয়া দেশের অবস্থার কথা বিদেশ থেকেই জানতে পারছিলেন শেথ হাসিনা। সে বছরই পেয়ে যান বাবার পড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লাগের দায়িত্ব।
১৭ই মে, ১৯৮১। দেশে ফিরলেন শেখ হাসিনা। মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য। শেখ সাহেবের মেয়ে ফিরে এসেছে। আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি ফিরে এসেছে। নেতার আগমণে প্রাণ ফিরে পেল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেদিন ঢাকায় প্রায় ১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল। জয় বাংলা… জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে কেঁপেছে পুরো ঢাকা।
বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল নাবিকবিহীন নৌকার মতো। ঝড়ে টালমাটাল একটা দলকে সামলানোর দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। সিনিয়র কয়েকজন নেতার বিদ্রোহ, দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা, রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দল গঠনে মনোনিবেশ করে শেখ হাসিনা।
নির্যাতন, নিন্দা, কষ্ট, বঞ্চনা নিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজ করেছেন শেখ হাসিনা। বলিষ্টভাবে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করেছেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হারলেও মনোবল হারাননি শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে জয়ের মধ্য দিয়ে বাবার মতো তিনিও ধরেছেন দেশের হাল। এরপর আরো দুবার বাংলাদেশের উন্নয়নের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন শেখ হাসিনা।
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হবার পর পরই তিনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতিতে অভূতপূর্ব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে যেমন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না তেমনি শেখ হাসিনার জন্ম না হলে সুখী সমৃদ্ধ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়ে উঠতো না আমাদের প্রিয় এই জন্মভূমি।
গত কয়েক যুগ ধরে বাংলার মানুষের মুখে সুখ-শান্তির জন্য কাজ করছেন শেখ হাসিনা। মানুষের দুঃখ কষ্টে তিনি মোমের মতো কোমল। অনাথদের বুকে টেনে নিয়েছেন। অনাহারীর ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন অন্ন। দুর্বলকে দিয়েছেন বল। মানুষের অধিকারের লড়াইয়ে থেকেছেন রাজপথে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা পাহাড়ের মতোই কঠিন। শত প্রলোভনেও তাকে দমাতে পারেনি শত্রুপক্ষ। জীবন নাশের হুমকিতেও থেমে থাকেননি তিনি। অন্যায়ের কাছে কখনোই মাথা নত করেননি। দেশের শত্রুদের ছেড়ে কথা বলেননি। অনাচারীর সামনে ঢাল হায়ে দাঁড়িয়েছেন বছরের পর বছর। বাবার মতো দৃঢ়, স্বাধীনচেতা, বলিষ্ট, আপোষহীন নেতার নাম শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু যেমন বছরের পর বছর ধরে দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, শেখ হাসিনা সেই স্বাধীনতা ধরে রাখতে সংগ্রাম করছেন।
আজ ২৮ সেপ্টেম্বর। আজ বাংলার ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা সেনানীর জন্মদিন। শেখ মুজিব বাংলাদেশকে দিয়েছেন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। বঙ্গবন্ধু কন্যা সেই স্বাধীনতার মান ধরে রাখতে লড়ছেন। মেধা, শ্রম, অভিজ্ঞতা, মায়া-মমতা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি করছেন তিনি।
শেখ হাসিনার কারণে বাংলাদেশ আজ কেবল এশিয়া নয় পুরো বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল। উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে দারিদ্রের হার। স্বাধীনতা ৫০ বছর পূর্তির প্রারম্ভে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। বিশ্বে যখন আজ অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি তরতর করে এগিয়ে চলছে। দেশের যে কোনো সমস্যা সমাধানে তিনি অত্যন্ত আন্তরিক।
প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে নিজেদের অর্থে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু। বাংলাদেশের পদচালনা এখন মহাকাশে। বিদ্যুত উৎপাদনে রেকর্ড, নিউক্লিয়ার পাওয়ারপ্ল্যান্ট, মেট্টোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সমুদ্র সীমা জয়, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, করোনাকালীন অস্থিরতা বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্য সবই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার বলিষ্ট নেতৃতত্বের কারণে। শেখ হাসিনাই দেশকে দেখিয়েছেন এক ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন।
শেখ হাসিনা বিশ্বের একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং একজন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কাঠামোগত রূপান্তর সম্ভব হয়েছে। রাখাইনে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি স্থাপ্ন করেছেন মানবতার উজ্জল দৃষ্টান্ত।
নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ় মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলি ছাড়া আপামর জনগণের নেতা হওয়া সম্ভব নয়। বলিষ্ট নেতৃত্বগুণে শেখ হাসিনা আজ শক্তিশালী বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর। বাঙালির জাতীয় ঐক্যের প্রতীক ও বাঙালি জাতির সকল আশা-ভরসার নিরাপদ আশ্রয়স্থল তিনি। সততা, আত্মত্যাগ, দূরদর্শীতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন শেখ হাসিনা। জনদরদী ও মমতাময়ী এই নেত্রী দেশের মানুষের কল্যানের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন, ঠিক যেমনটি করেছিলেন বাবা শেখ মুজিবুর রহমান।
আপনাকে শত কোটি সালাম। হাজার বছর ধরে বাঙালির হৃদয়ে আপনি সদাজাগ্রত থাকবেন। শুভ জন্মদিন, মমতাময়ী মা শেখ হাসিনা।