আত্মউন্মোচনের পাঁচটি কবিতা
[কবি–পরিচিতি : ‘প্রিয়াংকা বিশ্বাস’ বাবা-মায়ের দেয়া শখের নাম ‘প্রিয়াংকা বিশ্বাস’ এর সাথেই আমার পথ চলা । ১৯৮৯ সালের ৭ ডিসেম্বরে এসেছি পৃথিবীতে,জন্মস্থান বন্দরনগরী খুলনা। তবে মোহনীয় শৈশব-কৈশোরটা পার করেছি সাতক্ষীরায় । ‘সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে মাধ্যমিক এবং ‘সাতক্ষীরা দিবা-নৈশ ডিগ্রি কলেজ’ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করি ।পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন এবং নিজ সংসারে পা ।সংসারের অবসর সময়টাতে লেখালেখির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে প্রচন্ড আনন্দ অনুভব করি । এরপরে ২০১৭ সাল থেকে আমার নিবিড় সখ্যতা গড়ে উঠেছে কবিতার সাথে । অমর একুশের গ্রন্থমেলা ২০২০ এ আমার প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘চিলেকোঠার ভাবনা’ প্রকাশিত হয়েছে । নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম কবিতা নামক কিছু লেখার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম । যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা ব্যক্তিগত ডায়রির পাতায় ওরা নিদ্রা যাপন করতো । কখনও আলোর মুখ না দেখলেও এক জোড়া হাস্যোজ্জ্বল চোখ ওদের পাঠ করে আমায় উৎসাহ দিত , সেই চোখ জোড়া আমার মায়ের । এরপরে নয়-দশ বছরের বিরতির পরে আমার আবারো কবিতার জগতে ফেরা ।অলীক সুখের অন্বেষণে অনুভূতি সাজাই এবং ভাগ করে নিই বন্ধু-পরিজনদের সাথে ।]
১. ঠিকানাহীন প্রাপক
আমায় একটা ঠিকানা জোগাড় করে দেবে ?
যেখানে শঙ্কা লুকিয়ে চিঠি পাঠালে অনুভূতির কঙ্কালরা নিথর পড়ে থাকবে না;
চৌকাঠ কিংবা লেটারবক্স থেকেআসবে না খসখসে কোন আওয়াজ ।
প্রাপকহীন ঠিকানা পাব এমন নির্জীব পৃথিবী আজ আমাদের দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত
তবে তা অযাচিত অতিথির বেশে ।
তোমরা কি শুনতে পাও না তাদের কড়া নাড়ার একঘেয়ে শব্দ ?
ঝগড়াটে শালিকের মতো উৎপাতে মত্ত পৃথিবীটা আজ রৌদ্র-তাপে ধুকছে
নিভাঁজ কাগজে ধুলো পড়ার আগেই তাই ক্রমাগত ফুঁ দিয়ে যাই ।
একটা ঠিকানার বড় প্রয়োজন দেবে আমায় এমন কোন ঠিকানা?
জলরঙের ফোঁটায় ফোঁটায় দুঃখ একে তার বুকে কিছু কলমের আঁচড় কেটে রেখেছি।
এখন কেবল ঠিকানার প্রতীক্ষায় আছি – তোমরা চাইলে আমাকেও চিঠি পাঠাতে পারো
প্রেরকেরও তো সাধ হয় ঠিকানাহীন প্রাপক হতে ।
২. অপ্রাপ্তির গোলকধাঁধাঁয়
তোমার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল চৈত্রের কাঠফাটা রোদে ।
রাস্তার শেষে , ভাঙা শিব-মন্দিরের ধারে ।
কোন এক বিষণ্ণ বিকেলে তুমি কৃষ্ণচূড়া দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বলেছিলে ;
‘দেখো দেখো কী সুন্দর রাতুলের লালিমা !’
আমি চোখ তুলে তাকাতেই ওরা টুপ করে ঝরে পড়েছিল মাটিতে ,
এক রাশ অবজ্ঞা নিয়ে যেন সেদিন চোখ রাঙালো আমায় !
জীবনের কক্ষপথের অনূদিত রঙিন সব দিনগুলো—
ভূতের গল্প থেকে কফির চুমুকের ফাঁকে মেঘদূত-সঞ্চয়িতার ছন্দ ,
সবকিছুকে পাশে রেখে আচমকা এ বিচ্ছেদের আয়োজন
নিতান্তই নীরস অভিমানের অনভিপ্রেত অভিশাপ ।
হয়তো এই দিনটির জন্যই তুমি অপেক্ষা করেছো ।
তাই তুমি অস্ত যাওয়ার আগেই হয়তো আমি জ্বলে উঠেছি শেষবার –
ভালোবাসার গায়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জমছে অপেক্ষা
প্রাগৈতিহাসিকের ডাকাত হয়ে হানা দিয়েছে জলকবুতর ।
অদূর সাগর থেকে ফিরে আসছে মাছ ধরার ক্লান্ত ট্রলার
নিভু নিভু আলোয় চেনা পথ ধরে আমারও ফেরার সময় হয়ে এলো প্রায় ।
আজ আসি তবে !
এখন আমি ডুবে থাকতে চাই অতল গভীর নীরবতায়
আমার মন বীণায় সুর তুলেছে রাগ-সরস্বতী ।
অশুভ এ লগ্নে কেমন যেন এক পলকে জানা হলো সব অজানা —
তুমি আসলে আমার নও , ছিলেও না কখনো !
৩. কাঠ-গোলাপের সংসার
সংসারের সৌরভ সেজে বহুকাল আগে গোলাপকে হটিয়ে
একজোটে ফুটেছিল কিছু কাঠ-গোলাপ ।
ঠিক যেন জীবনের ফুলদানীর শোভা হয়ে আলো ছড়ানো পঞ্চ পাপড়ির লীলা ।
নিখুঁত আলপনা আঁকা মেঝে, ঝুল-বারান্দার ছোট্ট দোলনা,
রসুই ঘরের পাঁচফোড়নের ঝাঁঝ কিংবা শোবার ঘরের ঝা চকচকে আয়নাটা –
সবটা জুড়েই সুবাস বিলাতো ওরা ।
তুমুল সুঘ্রাণ ছড়িয়ে মাতিয়ে রাখতো দাম্পত্যের সফেদ প্রাচীর ।
প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর আনন্দময় চিলেকোঠা অথবা নিষিদ্ধ ছাদের কার্নিশে
সহসাই একদিন দম্পতির খুনসুটিরা ক্লান্তিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসলো ।
কিছু দ্বিধার গোলকধাঁধাঁয় ডুবে যেতে যেতেই
আমি তখন জীবনকে ছুঁড়ে দিলাম সেই প্রশ্নটা –
বয়সের গাছপাথরে ভারগ্রস্ত দাম্পত্য আসলেই কী বড্ড ভারী হয় ?
নাকি সাপ-লুডু খেলার ছলে ভাগ্যের প্রবঞ্চনায় মই গুঁড়িয়ে দিতে হয় ?
হিসেবটা জানা কারোরই হলো না আজও –
অমীমাংসিত রহস্যের মাঝপথে দাঁড়িয়ে সমাধান খুঁজতে যাওয়াটা
তাই নিছক বোকামি ।
পথিকের ভার বুকে নিয়ে ছুটে চলা পথের কখনো ক্লান্তি আসে না ,
নিয়মের পরিহাসে সংসারে ছড়িয়ে পড়ে কিছু অচেনা বুনো ফুলের ঘ্রাণ ।
দাম্পত্যের চৌকাঠে কেবল পড়ে থাকে চিরচেনা কাঠ-গোলাপের কঙ্কাল –
আমাদেরই অজান্তে লীলাভঙ্গ হয় তাদের ।
৪. অপেক্ষার পরাজয়
ইট বালি কাঠের ধূসর জীবন সুরকি দিয়ে রং মাখাই I
কপিকল দিয়ে রোজ সূর্য মামাকে ওঠাই আর নামাই I
অলস শ্রমিক কাজ ফেলে নড়বড়ে-জীর্ণ ওভারব্রিজে বসে আছে অপেক্ষায় I
ফুরিয়ে যাওয়া সিগারেটে সুখটান দেয়া তার বারণ I
বাসস্টপে অপেক্ষমান নীলাভ সানগ্লাস চোখে তরুণী
স্বেচ্ছায় মিস করছে গন্তব্যের গতিকে –
শূন্য ফুলদানীও পূর্ণতা পাবার লোভে তার ঘরে ফেরার অপেক্ষায় কাতর I
তরুণীও ঠিক ফুলদানীর ন্যায় অনন্তকাল দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ;
রজনীগন্ধার তোড়া হাতে অবয়ব সমেত একটি গেরুয়া পাঞ্জাবির I
বোকা বাক্স থেকে এবার চোখ রাখি দূরবীনে I
ফুর্তিবাজ মানুষগুলো অযথাই ভীড় জমিয়েছে ;
পলাতক প্রেমিক-প্রেমিকারা আজ সংঘবদ্ধ আসামি I
তোমার আসার কথা ছিল আজ,খুব ভোরে-
তুমি এলেই ওরা হয়ে যাবে মন্দিরের পূজারী I
মাছের ভ্যান থেকে ছলাৎ করে লাফিয়ে রাস্তায় নামলো মাছেরা I
সমুদ্র বাসর হবে আজ যানজটের নগরীতে I
বোকা বাক্স থেকে চোখ সরিয়ে আবার রাখি দূরবীনে
দিনপঞ্জি মনে করিয়ে দেয় আজ তুমি আসবে বলেছিলে –
ফুলদানিতে জিইয়ে রাখা রজনীগন্ধা বুড়িয়ে যাবার আগেই I
৫. কবির চিলেকোঠা
প্রত্যেক কবির একটা নির্ভেজাল চিলেকোঠা থাকে
অবসর ভাজার চিলেকোঠা ;
ঠিক যেমন টগবগে তেলে ফোটা জিলাপীগুলোকে
আরো গাঢ় করে ভাজা হয় ,
ঠিক তেমন !
চিলেকোঠায় থাকে দুপুরের পরিশ্রান্ত ঘাম শুকিয়ে নেয়ার
নিদারুণ ব্যস্ততা ;
পেটের দায় থেকে ঠিকরে আসা ঘর্মাক্ত ধারা –
ঠিক যেমন আয়নার উঁকি দিয়ে যায় গুটিকয়েক
প্রিয় মুখের আদল,
ঠিক তেমন !
চিলেকোঠায় থাকে জীবন থেকে কুড়ানো কলমের
খসখসে বদহজমের দায় ;
সাদা পাতায় কালির উগরে দেয়া রক্তাক্ত রসদ –
ঠিক যেমন দেশ কালের অবক্ষয় ছাপিয়ে উঁকি দেয়
মুখোশে ঢাকা মানুষের অদৃশ্য থাবার দাপটে ,
ঠিক তেমন !
চিলেকোঠায় থাকে গুটিকয়েক সুখ-পাখিদের গড়া
সংসারের টুকরো সাতকাহন ;
পোকামাকড় আর কিছু শস্য-দানার জীবনচক্র;
ঠিক যেমন উচ্চাভিলাষী জীবনবোধ কবিকে
পেটের দায় থেকে মুক্তি না দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে,
ঠিক তেমন !
প্রত্যেক কবির একটা নির্ভেজাল চিলেকোঠা থাকে
চোখের জল শুকানোর চিলেকোঠা ;
ঠিক যেমন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কারাগারের ঘুলঘুলি গলে আসা
সূর্যকিরণ স্পর্শে নৈরাশ্য মুক্তির স্বাদ পায়,
ঠিক তেমন !
স্বদেশ-অন্বেষার পাঁচ কবিতা
[কবি–পরিচিতি : তৈমুর তাহের। ১৯৮৯ সালের ৫ আগস্ট যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার মহেশপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন। কর্মজীবনে প্রভাষক (বাংলা) হিসেবে সাউথ পয়েন্ট কলেজ ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজে চাকুরী করেছেন। বর্তমানে জাপান ইন্টারন্যাশনাল ড্রিম স্কুল অ্যান্ড কলেজে, (পূবাইল, গাজীপুর) প্রভাষক হিসেবে কর্মরত।]
১. এই বাংলা (সনেট)
এই বাংলার জল-স্থলে মিলেমিশে
এক অপরূপ, সে আমার প্রাণপালে
যায় নাড়া দিয়ে হিমেল হিল্লোল দোলে,
এমন প্রশান্তি বলো মিলে আর কীসে ?
মধু মাসের ম ম ঘ্রাণে না পাই দিশে
বরষায় প্রশোভিত কদমের কোলে
সঁপে নিসর্গ; শরত্ সাজে কাশফুলে,
নবান্নে ধানে-গানে চাষা ভাইও হাসে,
হিমালয় সমীরণে নামে যে শীতল
হাওয়া, বসন্ত দূত কুহু ডেকে কয়,
ঋতুরাজ গেছে এসে বাজাও গীতল!
নয়ন জুড়ানো বাংলার রূপ-ছায়
যে দিকে যায় দুচোখ ঐশ্বর্য অতল
জন্মান্তরে যেন আমি বাংলাকে পাই।।
২. প্রিয় প্রতীক্ষা
আজ তোমাকে নিয়ে চাঁদ দেখব তাই,
ভরদিন মুঠো মুঠো প্রতীক্ষায় কেটেছে
সময় আমার!
আয়োজন করেছি বিপুল
নিভৃতে নিসঙ্গে, তোমাকে সঙ্গ দেব তাই!
র্পূণিমা তোমার ভালোবাসার রং,
তোমার মনের রংধনু।
একতলার ছাদ-পাশে শিশু নারকেল গাছটি
তোমার অর্ন্তময় ঘনিষ্ঠজন,
দুলে এসে পড়ে তোমার সোনালি গায়
ভীষণ মায়ায়, তোমাদের মিতালিতে
র্নিনিমেষ চেয়ে থাকি জোছনার আড়ালে,
অদম্য ইচ্ছা ছিল আজ- দুজনে চাঁদের আলোয় গা ধুব
হরিত্ পাখির মতো,
আকাশের নিচে শুধু তুমি আর আমি,
আমরা দু’জন;
আমার সকলে ভঙ্গ দিয়ে সন্ধ্যায় শুরু হলো সকাল সকাল আকাশের আসমানি তোড়জোড় !
মেঘের কান্নায় মরে গেল
সাধের প্রিয় মিতালি আমার,
জোছনামিতালি!
আকাশের নীর আমার নীড়ছাদে মেতেছে,
জমিয়েছে সফেদ উল্লাস!
আজ নয় আরেক দিন,
আরেক দিন করব জোছনাস্নান দুজনে!
চলো, আজ মেঘদূতের কোলে হাত ধরে হাটি দুজনে,
রেখে হাত দুটি হাতে;
সিক্ত বসনে উষ্ণ শরীরে…!
৩. সিংহাসন
সিংহাসনের বেহায়া শরীরে দেখিনি চিহ্ন আমি,
শুনেছি আকৈশোর কাল কেবল-
’সিংহ চিহ্নিত আসন’!
জিজ্ঞাসা জেগেছে মনের জঙ্গম কোণে,
সিংহের মতো কেন ? আর কিছু নেই ?
যার সাথে যায় তুলনা!
বনের রাজা হলেও সিংহ তো পশু এক পাশবিক!
অথবা চারপেয়ে জানোয়ার!
তবু মানুষ ‘সিংহের বাচ্চা’ শুনে
মুগ্ধ মনে করে টান্ টান্ বুক,
গিরগিটির পেটের মতো।
এখন বুঝি বুদ্ বুদের কলেবরে-
সিংহাসনে যাঁরা বসেন, নন পশু তাঁরা;
শুধু বসেন-ই খালি, ঐ পশুচিহ্নিত সাধের আসনে!
তবে, বৈসাদৃশ্যের বালায়-ই খালি ?
ও আসনে বসতে, হতে হয় হিংস্র সিংহের মতো,
তীক্ষ্ণ-তীব্র দাঁত, নখগুলো র্নিমম শক্ত;
মাংসপেশী ভেদ করে যা অস্থিতে অস্তিত্ব প্রমাণ দেয়!
বজ্র হুঙ্কারে পালিয়ে বাঁচে ছিমছাম দেহের সুস্বাদু হরিণ! সিংহাসনের ক্ষ্যাপা মায়া,
মানবতাকে ঠেলে দেয় পশুর অরণ্যে !
চামচিকার মুখে চুমু খায়, লাথি মারে সজোরে সটান, সিংহাসন অচলায়তন বসে দেখে শুধু,
বুনো ষাড়ের উন্মাদ লড়াই, র্নিলজ্জ রক্তসন্ধি !
সেকালের সিংহাসন হয়েছে হালের গোদি,
অথবা মিউজিক্যাল চেয়ার ক্ষমতার!
সময় বদলায় ছুটে বিজলি-চপলা পায়,
বদলায় না শুধু সিংহাসন ও শোষণ…!
৪. আলোর আশা
মেঘ কেটে গগন পেটে
রোদ আসিবে
ঝড় শেষে শান্ত বেশে
অবনী হাসিবে
নীড়ের বিহঙ্গ করিয়া বিভঙ্গ
ছুটিবে তেপান্তর
আহার মুখে যাহার বুকে
প্রেম নিরন্তর
জঙ্গম পথ সঙ্গম রথ
ত্রস্তব্যস্ত শত
কলের গান সিলায়দিদির প্রাণ
নাচিবে ফেলে ক্ষত
অফিস পাড়া ফেলবে সাড়া
জনতার মিতালি
তুরাগ বাসে বসিয়া পাশে
অজানা গীতালি
টিএসসি সড়ক ভুলিবে মড়ক
রাজুর কোলে আসর
রিক্সা অন্দর প্রেম বন্দর
ছুটিয়া চলিবে বাসর
কোমল মতি টানিয়া যতি
শিক্ষালয়ে প্রাণ
পুস্তক হাতে কলম সাথে
শিক্ষাগুরুর জ্ঞান
হাজার স্বপন করিয়া যতন
পুষেছি এ বক্ষে
সকল লোক ভুলিয়া শোক
আলো পাক স্বীয় চক্ষে।।
৫. সোনালি সেদিন
আজ সে আতা গাছ নেই,
তোতা পাখিও নেই!
আঙিনা ছেয়ে গেছে
আগাছার জঞ্জালে ভরপুর,
ডালিম গাছটি বেঁচে আছে
বাজপড়া পোড়া গাছের মতন,
ফ্যাকাশে ডালিমদেহ পোকার
বসতবাড়ি যেন
মৌ আসে না, বসে না সেখানে।
তালগাছ দেখে এখন গাঁ চিনতে হয় না!
চিমনির বস্তা বস্তা ধোঁয়া
জানান দেয় গাঁয়ের গা,
কানা বগির চোখ ফুটেছে এখন
তাই পালিয়েছে বিজন বনে!
জোড়া জোড়া আমপাতার সাথে
চাবুক মেরে ঘোড়াচড়ার
যোগ-বিয়োগ মেলাতে পারে না কিশোর
বুবুকে তাই ডাকে না, বলে না সরে যেতে পাশে,
শাপলা-শালুকের বিল জলহীন মায়াহীন
নেই সেখানে বালিহাঁস কিংবা কাদাখোঁচা,
কলার-ভ্যালায় ভাসে না গ্রাম্য মেয়ে,
ডিঙি রাস্তা ডিঙিয়ে উঠেছে
কৃষকের গোয়ালের বাতায়!
হাট্টিমাটিম এখন বে-শিং পুরনো
মাঠের ডিমে নিমরাজি শিশু,
নবজাতক চোখ মেলে দেখে
অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ঝাঝালো আলো!
কীভাবে লাগে ভালো এসব
বাতিল খসড়া খাতা!
দিনগুলো চলে যায় ঘোড়ার ক্ষুরে ক্ষুরে
পোড়ায় কুরে কুরে মনের পাটখড়িতে।।
চারটি দ্রোহের কবিতা
[কবি–পরিচিতি : মোহাঃ বশির আলী, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ]
১. মুক্তির অপেক্ষায়
করোনার করাল গ্রাসে নিরুপায় সমগ্র মানবজাতি
ইতোমধ্যেই নিভে গেছে অনেকের জীবনের বাতি।
তবুও অনেক বাঙালি আয়োজন করছে চড়ুইভাতি
আবার কেউ কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে উঠছে মাতি ।।
ভিতরে ভিতরে বাঙালি জ্বলে পুড়ে হয়ে যাবে ছারখার
তবুও “কিছুই হবে না কভু” বলে আছে আত্মঅহংকার।
বাঙালি জাতি কখনো কথার কৌশলে মানবে না হার
যদিও অস্থি মজ্জায় ছেয়েও যায় কষ্ট ও দুঃখের ভার।।
আজ পুরো বিশ্বের একটাই সবিনয় আবেদন
উদাসীনতা না দেখিয়ে সকলেই হই সচেতন।
দেহ-মন-প্রাণে পরম সৃষ্টিকর্তাকে করি স্মরণ
যাতে করোনার নির্মম আঘাতে না আসে মরণ।।
২. মৃত্যুভীতি
জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিসরে দেখেছি অসংখ্য মরণ
দেখেছি মৃত্যুর প্রহসন, দেখেছি মৃত্যুর নানান ধরন।
কালের পরিক্রমায় সবাই করে থাকি তাদের স্মরণ
যারা নানা সংকটে মৃত্যুকে করেছেন সাদরে বরণ।।
সন্ত্রাস দমনের নামে সিরিয়দের করুণ মৃত্যুযজ্ঞ দেখেছি
টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দায়ে আফগানদের মৃত্যু দেখেছি।
জঙ্গি দমনের নামে ইরাকিদের বীভৎস মৃত্যুদৃশ্য দেখেছি
আর করোনার নির্মম আঘাতে মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল দেখেছি।
কিন্তু নানা রকমের মৃত্যু নানা রকম অনুভূতি
একেকটি মৃত্যুতে একেক রকমের সহানুভূতি।
করোনার কবলে পড়ে যারা দিচ্ছেন আত্মাহুতি
তাদের দাফন কাফনে নেই অনেকের মতিগতি।।
৩. স্তব্ধতা
করোনার কবলেই যেন থমকে গেছে সমগ্র বিশ্ব
কোন পরিবারের কর্তার মৃত্যুতে পরিবারটি নিঃস্ব।
তবুও আমার অগাধ বিশ্বাস- প্রত্যেকটি পরিবার
নতুন উদ্যমে জেগে উঠবেই সফলতা আনিবার।।
থমকে গেছে তুমুল প্রতিযোগিতার ফুটবল
ভেঙে গেছে হয়তো ফুটবলারদের মনোবল।
তবুও সবাই অন্তত একটা লক্ষ্যেই অবিচল
নতুনের প্রত্যাশায় মাঠে নামবে প্রতিটি দল।।
মাঠে থেমে গেছে লড়াই ক্রিকেটের ব্যাটে বলে
ভাটা পড়েছে হয়তো ক্রিকেটারদেরই কৌশলে।
তবুও আমার বিশ্বাস মিরপুর মুলতান আর গলে
শীঘ্রই ক্রিকেট ফের জমে উঠবে দর্শকের ঢলে।।
অনেকটা থেমে গেছে নোংরা আর অসম কথার লড়াই
হয়তো কিছুটা কমে গেছে অর্থ- সম্পদের হুজুগে বড়াই।
করোনাকালে সবাই পার করছে নানামুখী চড়াই উতরাই
ভাবছে নির্বিকার চিত্তে কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।
কোন দেশ কত বেশি অন্যের অর্থ সম্পদ করছে ভোগ
থেমে গেছে এসব নিয়ে নানারকম অমূলক অভিযোগ।
করোনারই কবলে যেন চাপা পড়ে গেছে অন্যসব রোগ
বিশ্ব নেতাদের চিন্তা চেতনায় হয়েছে নতুন মাত্রা যোগ।।
করোনার কারণে সমগ্র পৃথিবীই যেন আজ মৃত্যুকূপ
কোনো একদিন পৃথিবী সুস্থ হয়ে ধারণ করবে নবরূপ।
হয়তো জগতের সমস্ত অসৎ মানুষ হয়ে যাবে নিশ্চুপ
সেদিন হয়তো থাকবে শুধুই তোমার আমার প্রতিরূপ।।
৪. বোনের মুক্তি
আমি আমার বোনের মুক্তির কথা বলছি
যে বোন ধর্ষণের শিকার হয়েও নিগৃহীত
যে বোন লোক সমাজে মুখ দেখাতে চায় না
সেই বোনের মুক্তির কথা বলছি।।
আমি আমার বোনের মুক্তির কথা বলছি
যে বোন যৌতুকের কষাঘাতে জর্জরিত
যে বোন যৌতুকের কবলে পড়ে গৃহ হারা
সেই বোনের মুক্তির কথা বলছি।।
আমি আমার বোনের মুক্তির কথা বলছি
যে বোন ইভটিজিংয়ের কারণে দিশেহারা
যে বোন লজ্জা ও ঘৃণায় আত্মহত্যা করতে চায়
সেই বোনের মুক্তির কথা বলছি।।
আমি আমার বোনের মুক্তির কথা বলছি
যে বোন লোলুপ শ্রেণীর ভোগের বস্তু
যে বোন বাজারের পণ্য সামগ্রী সদৃশ
সেই বোনের মুক্তির কথা বলছি।।
আমি আমার বোনের মুক্তির কথা বলছি
যে বোন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পতিতা হয়
যে বোন ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেকে বিলিয়ে দেয়
সেই বোনের মুক্তির কথা বলছি।।
আমি আমার বোনের মুক্তির কথা বলছি
যে বোন শিক্ষিত হয়েও নিপীড়িত- নির্যাতিত
যে বোন এখনও মুক্ত জীবনের প্রত্যাশী
সেই বোনের মুক্তির কথা বলছি।।
ভালোবাসার সনেটগুচ্ছ
[কবি–পরিচিতি : এ.এস.এম. কবির হোসাইন, ডাকনাম: রানা। জন্ম: ১ জানুয়ারি, ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ। পিতা: আব্দুল বাছির সরকার, মাতা: প্রয়াত নাজমা বেগম। গ্রাম: অলহরি দুর্গাপুর, ডাকঘর: রাণীগঞ্জ, উপজেলা: ত্রিশাল, জেলা: ময়মনসিংহ। শিক্ষাজীবন : শিক্ষাজীবন শুরু অলহরি দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক: ২০০৫ সালে পোড়াবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান শাখায় মাধ্যমিক পাশ। উচ্চ মাধ্যমিক: ২০০৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে মানবিক শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ হতে স্নাতক সম্মান ও ২০১২ সালে স্নাতকোত্তর পাশ। কর্মজীবন: বর্তমানে ঢাকার সিদ্বেশ্বরী কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে( নাটক) জড়িত ছিলাম।
১. ভালোবাসা
ভালোবাসা সৃষ্টি করে, আবার নাশও,
ভালোবাসা হাসায়, আবার কাঁদাইও।
ভালোবাসা মন্দ হয়, আবার তা ভালো,
ভালোবাসা ছাড়া হয় নাকি কেউ কারো।
মায়ের ভালোবাসার তুলনা যে নাই,
বাবার ভালোবাসা কখনও হারায়।
গৃহে সুখ পতি-পত্নীর ভালোবাসায়,
ভালোবাসাহীন হলে ভোগে হতাশায়।
স্রষ্টাকে ভালোবাসলে হয় যে ধার্মিক,
মানবকে ভালোবাসলে হয় প্রেমিক।
দেশপ্রেমিক ভালোবাসলে স্বদেশকে,
ভালোবাসাহীন হৃদয় ডুবে আঁধারে।
এই অধমের চাওয়া তো বেশি নয়,
পবিত্র ভালোবাসারই হোক বিজয়।
২. মধ্যবিত্ত
জীবনে দুঃখ বেদনা অনেক সহে,
ক্ষণিকের সুখ এলেও নিরব রহে।
সংসারে সব সময় টানাপোড়েন,
অনেকেই তাদের মধ্যবিত্ত বলেন।
অনেক স্বপ্ন দেখে, বাঁচে তারা আশায়,
স্বপ্নগুলো চোরাবালিতে হারিয়ে যায়।
স্বপ্ন হারিয়ে তারা হয় যে অসহায়,
বৃত্তের চারপাশে শুধু ঘুরে বেড়ায়।
পণ্যের দাম বাড়ে, কারও নাভিশ্বাস,
কেউ অর্থের লোভী, মধ্যবিত্তের নাশ।
সংসারে নেমে আসুক শত অভাব,
মাথা নত না করাই তাদের স্বভাব।
যাঁরা জগতে টিকে থাকে করে লড়াই,
আমি তাঁদের হাজার সালাম জানাই।
৩. বাবা
বাবার মতো প্রিয় মা ছাড়া কেউ নহে,
সন্তানের জন্য সে, নিরবে সব সহে।
সন্তান সুখে থাকে জনকের ছায়ায়,
জীবন যুদ্ধে যিনি নামেন এ ধরায়।
জীবনে আসুক না যত রকম ঝড়,
বাবা দিয়ে থাকেন সন্তানকে অভয়।
সন্তান দুখী হলে, বাবা যে দুখী হয়,
সুখী করতে বাবা যে, সব কষ্ট সয়।
সন্তান মানুষ হলে বাবা হয় সুখী,
অমানুষ হলে বাবা সবচেয়ে দুখী।
বাবার নিরব কষ্ট বুঝে কয়জনা,
নিজে বাবা হলে বুঝে বাবার বেদনা।
কেউ কখনো বাবাকে দিও না যন্ত্রণা,
সকল বাবা সুখী হোক করি কামনা।
৪. স্বপ্ন
স্বপ্ন দেখতে সবাই কিন্তু ভালোবাসে,
স্বপ্নসারথি হতে পারেন কয়জনে?
সবার মতো আমারও তো স্বপ্ন ছিলো,
স্বপ্নের জগতে থাকতে লাগে যে ভালো।
স্বপ্নেই মানব আশার ভেলা ভাসায়,
স্বপ্নহীন মানবই ভোগে হতাশায়।
জীবন যুদ্ধে হেরে যারা স্বপ্ন হারায়,
তাদের আশার ভেলা ডুবে দুরাশায়।
জীবন সংগ্রামে বিজয়ী হয় তারা,
স্বপ্ন সত্যি করতে কষ্ট সহেন যারা।
আশায় মানব বাঁচে, মনে স্বপ্ন বুনে,
আশাহীন মানব ও জড় ভিন্ন নহে।
জগতে স্বপ্নসারথি যদি হতে চাও,
আত্মবিশ্বাস নিয়ে পথে এগিয়ে যাও।
৫. অর্ধাঙ্গী
নারী মাতা, নারী ভগিনী, নারী অর্ধাঙ্গী,
বিভিন্ন রূপে নারী কারো না কারো সঙ্গী।
স্ত্রী ডেকে আনে সুখ পাখি স্বামীর গৃহে,
সুখ পাখি পালিয়ে যায় স্ত্রীর বিরহে।
সংসারে শান্তি আনে স্ত্রী মানুষ কহে,
অশান্তির পবন স্ত্রীর কারণে বহে?
স্বামীর উন্নতি হয় স্ত্রীর ভালো গুণে,
অবনতি হয় মন্দ থাকে যদি মনে।
সংসার তরীর বৈঠা যে স্ত্রীর হাতে,
মাঝি মন্দ হলে তরী যাবে ভুল পথে।
হিংসা-দ্বেষ যদি থাকে স্ত্রীর অন্তরে,
সুখ-শান্তি কিছু কি থাকে সে সংসারে?
স্বামী – স্ত্রীর ভালোবাসায় ফুটে কমল,
স্বামী – স্ত্রী উভয়ের মন হোক ধবল।
আত্মবিশ্বাসের তিন কবিতা
[কবি–পরিচিতি : লিসান আনিছ। জন্ম : ২৪ অক্টোবর ১৯৮৭ কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার কাজিয়াতল গ্রামে। স্কুল (হিলপুল ফুজুল আদর্শ স্কুল) ও কলেজ (এসএ সরকারি কলেজ) জীবন কুমিল্লার দেবিদ্বার থানায়। পিতা: আব্দুল জলিল মাতা: রাহিমা বেগম অনার্স ও মাস্টার্স: বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। প্রতিষ্ঠাতা: ‘Educakes’ (এনিমেটেড) শিক্ষামূলক চ্যানেল। ‘অপরাজেয়’ ব্যান্ড দল।]
১. ভয় পেয়ো না
কত মৃত্যু, কত দেখবে জরা,
ভয় পেয়ো না।
কত স্বপ্ন ভেঙ্গে কাঁদবে ধরা,
ভয় পেয়ো না।
কত হাহাকার চাপা যন্ত্রনাতে,
ভয় পেয়ো না।
কত উল্লাস মরে আজ প্রভাতে,
ভয় পেয়ো না।
ভয় পেয়ো না
কপট-কঠিন সময়টাকে।
বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাপ্রদীপ নেভার ফাঁকে।
ভয় পেয়ো না
অসীম মরুয় রুদ্রপ্রতাপ।
পথের অসুখ, পাথার ভরা শোক-অভিশাপ।
ভয় পেয়ো না,ভয় পেয়ো না,ভয় পেয়ো না।
ভয় পেয়ো না
অন্ধকারে কীটের ধ্বনি।
পাতাল তলে উতাল লাভার অগ্নিখনি।
ভয় পেয়ো না
‘আর কত দূর’ ভাবনা জালে।
কামড়েধরা হায়েনা দলের কূটকচালে।
ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না।
ভয় পেয়ো না
ঘোর অভাবে পিতার বদন।
মা জননির শূণ্য হাড়ির ছোট্ট সদন।
ভয় পেয়ো না,
সাহস ফুলে মেঘ জমেছে।
ভিজবে চল নতুন জীবন ঐ ডেকেছে।
ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না।
২. আমি
আমি কেবল তোমার জন্য কবি,
তোমার জন্য লিখব আমার ভেতর বাহির সবি। আমি কেবল তোমার জন্য কবি।
আমি কেবল তোমার জন্য পাগল,
তোমার জন্য উঠব নেচে বাজিয়ে উগ্র মাদল। আমি কেবল তোমার জন্য পাগল।
আমি কেবল তোমার জন্য গাই,
তুমিই থেকো শুধু শ্রোতা কাউকে নাহি চাই।
আমি কেবল তোমার জন্য গাই।
আমি কেবল তোমায় ভালোবাসি,
সারা জগৎ ঘুরেও দেখো তোমার কাছেই আসি। আমি তো তোমায় ভালোবাসি।
আমি ধ্যানে তোমার রূপে থাকি,
আঁধার-আলো, মন্দ-ভালো আর যতটুক বাকি।
আমি ধ্যানে তোমার রূপেই থাকি।
৩. বাঞ্ছা
মানুষরূপে এই ধরাতে
আর আমারে চাই না।
মন গগনে আমার আলো
আমি নিজেই পাই না।
কে আমারে পিছু ডাকে?
আশায় আশায় মনে রাখে।
কে আবার গভীর ধ্যানে
আমার প্রেমের ছবি আঁকে?
ছেড়ে দে রে সবাই আমায়
আমারি তো আমি না।
ক্ষমা করে দে করে পণ
ভাঙবি না এ পাগলের মন।
ভেঙে গেলে কাঁচের কাগজ
কালি তাতে সয় না।
বিদায় দে রে প্রদীপ জ্বেলে
সামনে কিছুই হেরি না।
প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ চার কবিতা
[কবি-পরিচিতি: চৈতী চক্রবর্তী একজন শিক্ষক, গবেষক, প্রশিক্ষক ও অভিনয় শিল্পী। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এখন তিনি এই বিভাগেই এম.ফিল গবেষক হিসেবে অধ্যয়নরত আছেন। তার গবেষণার বিষয় বাংলাদেশের নাটকে মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১- ১৯৯০) এছাড়া, তিনি এল.এল.বি সম্পন্ন করেছেন। তিনি প্রথম আলো বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের অনুষ্ঠান বিষয়ক সম্পাদক ও ফ্রাইডে থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ ফিল্ম ফ্যাসটিভ্যাল ২০২০ -এ বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে মুক্ত আসরের নিয়মিত আয়োজন আমিই নজরুল – এ প্রোগ্রামটি উপস্থাপনার সাথে যুক্ত আছেন।]
১. পূর্ণিমা
শৈশবে বাবার হাত ধরে
নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে
চাঁদের সৌন্দর্যের সাথে পরিচয়।
বাংলা বিভাগে সাহিত্য
পড়তে পড়তে
পূর্ণিমার সৌন্দর্যে
অবগাহন করেছি
প্রতিনিয়ত ।
এখন,
এ ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে
প্রতিটা পূর্ণিমার জন্য
অধীর আগ্রহ নিয়ে
প্রতীক্ষা করি ।
এক পূর্ণিমা শেষ হলে পঞ্জিকার
পাতায় খুঁজে ফিরি
পরবর্তী পূর্ণিমার আগমন ।
চাঁদের রূপসুধায় মোহগ্রস্ত হতে হতে
ভাবনায় নিজেকে হারাই।
অনুভব করি ,
অনেক দিন বেঁচে থাকার
ব্যাপক ব্যাকুলতা।
শারীরিক ভাবে না হলেও
আলো ছড়িয়ে দিতে চাই
কর্মে।
ঠিক পূর্ণিমার মতো করো ।
২. বৃষ্টি
মেয়েটির আগমন এক বসন্তে
বসন্ত তার প্রিয় ঋতু।
কোকিলের ডাক তাকে পাগল করে,
গন্ধরাজ-এর ঘ্রাণে মোহিত হয় সে।
বৃষ্টির শব্দ তার খুব পছন্দ
বৃষ্টির জল তার কাছে পবিত্র,
বৃষ্টি তার প্রতীক্ষিত।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভীষণ ভালোবাসে,
বৃষ্টি নামলেই শিহরিত হয় সে
তার দুচোখ যেন বৃষ্টির অঝর ধারা।
সেই চোখ ও একদিন জল শূন্য
বাবার নিথর দেহটার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি
ঈশ্বরের কাছে আকুতি জানিয়েছিল,
বাবার শেষকৃত্য পর্যন্ত কোনো বৃষ্টি যেন
তার চোখে উঁকি না দেয়।
মেয়েটার ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল
চোখে অনেক মেঘ ছিল
কিন্তু কোন বৃষ্টি দেখেনি কেউ।
পাথরে বেধে বুক বাবার মুখাগ্নি করেছিল মেয়েটি ।
অগ্নির বর্তমানে
হঠাৎ বৃষ্টি এসে উপস্থিত
বৃষ্টি এসে ধুয়ে দিল বাকী কাজটুকু
মেয়েটি চোখের জল আর বৃষ্টির জলে একাকার করে
এ জনমের মতো তার বাবাকে বিদায় জানালো ।
মেয়েটির প্রিয় ঋতু এখন বর্ষা ।
৩. মেয়েটি
মেয়েটির লাল রং খুব পছন্দ
আপনজনের মতো লাল টিপ, তার কপাল জুড়ে
থাকে বার মাস।
লাল শাড়িতে সে খুঁজে পায়,
তার সকল আনন্দ।
আলতা তার শৈশবের সখী,
কাঁচের লাল রেশমি চুড়ি ভীষণ ভালোবাসে সে।
লাল টিপ, আলতা, ল চুড়ি আর লাল শাড়ি
নিয়ে সে স্বপ্ন বুনে
আনমনে একের পরে এক।
কৈশোর ছেড়ে যৌবনে এসে
সে অনুধাবন করে
তার পৃথিবী জুড়ে লাল রং এর আনা গোনা নয়,
চারদিকে অন্য রং হেসে বেড়ায় ।
এখন মেয়েটির
নীল রং এর সাথে নিত্য বসবাস ।
তবে
তার মনের এক কোনে
সযতনে রাখা আছে ,
প্রিয় লাল শাড়ি ,আলতা, কাঁচের চুড়ি আর
বড় একটা লাল টিপ।
হয়তো কোনো এক ভোরের প্রতীক্ষায় ।
৪. নদী
প্রিয় নদী,
বহুরূপিণী তুমি!
মনোহর উচ্ছল তোমার জলের ধারা।
তুমি প্রবাহিত হও
বিরামহীন ।
তোমার কী অনেক অভিমান জমে আছে?
যা তুমি ধারণ করে আছো
সংগোপনে,
তোমার কষ্ট বেড়েই চলে।
তোমার বেদনা অনেক,
গভীর থেকে গভীরতর!
তোমার দুঃখগুলো তুমি আড়াল করে রাখো,
রেখে দাও সযতনে।
তোমার সৌন্দর্যে সবাই বিমোহিত ।
তাই নদী ও নারী একই !