রাত ৩:৫৮ বৃহস্পতিবার ১৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ২রা জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

হোম বিদেশ চীনকে সরিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে ভারতের যা দরকার

চীনকে সরিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে ভারতের যা দরকার

লিখেছেন মামুন শেখ
চীনকে সরিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে ভারতের যা দরকার-durantobd.com
Spread the love

২০০৫ সালে জাতিসংঘের তখনকার মহাসচিব কফি আনান নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের জন্য একটি প্রস্তাব আনেন। তিনি যুক্তি দেখান, নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান যে কাঠামো সেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শক্তি সাম্যের বিবেচনায় করা। এখনকার বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।

জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসও নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার জ৯রুরি বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতিসংঘকে আরও গণতান্ত্রিক ও বৈচিত্র্যমণ্ডিত করতেও এটি দরকার।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ পাঁচটি- যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং চীন।

গত সাত দশকে বিশ্ব অনেক বদলে গেছে। দেশগুলোর মধ্যে ঘটেছে শক্তির তারতম্য। এরই ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু দেশ জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে আছে- ব্রাজিল, জাপান, ভারত এবং জার্মানি। ইদানীং মুসলিম দেশ তুরস্কও জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ পেতে চায়। তবে এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা দেখা যায় ভারতের মধ্যে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের প্রভাবশালী স্থায়ী সদস্য চীনের সঙ্গ দা-কুমড়া সম্পর্ক নিয়ে ভারত কি পারবে তার আশা পূরণ করতে?

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে পারবে ভারত?

১৯৭৪ সারে ভারত সর্ব প্রথম পারমানবিক বোমার পরীক্ষা চালায়। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো। এরপর থেকেই ভারত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের দাবি করে আসছে। তাদের যুক্তি হলো- আমরা পারমাণবিক শক্তিধর এবং একই সাথে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। তবে বর্তমান বাস্তবতায় তাদের এই প্রস্তাব কতটা বাস্তব সম্মত?

পরমাণু অস্ত্রের শক্তি:

আসলে পারমানবিক অস্ত্র থাকলেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ চাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নাই। কারণ, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, ইজরায়েলের (আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি) মতো দেশগুলোও পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী। পারমাণবিক অস্ত্রকে যদি এক্ষেত্রে মাপকাঠি হিসেবে দেখা হয় তাহলে সৌদি আরব, ইরান, তুরস্কের মতো দেশগুলোও পরমাণু অস্ত্র তৈরির পেছনে ছুটবে। এটা বরং বিশ্বে পরমাণু অস্ত্র বিস্তারের জন্য উস্কানি হিসেবে কাজ করবে; যা যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলো কখনোই চাইবে না। বলতে গেলে জাতিসংঘের প্রায় সব সদস্য এর বিরোধী।

আরো তো অনেকেই চায়:

কিছু দেশ অর্থনৈতিক শক্তির কারণেও স্থায়ী সদস্য হতে চায় এবং তারা নিজেদের ভারতের মতোই আঞ্চলিক শক্তি মনে করে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় জাপানের কথা। জাপানের এই অবস্থানের পক্ষে বহু দেশ আছে। নিজেদের জাপানের মতো মনে করে দক্ষিণ করিয়া। ভারতের চেয়ে জাপান অনেক আগে থেকেই স্থায়ী সদস্য পদ দাবি করে আসছে। তাই জাপানের আগে ভারতকে স্থায়ী সদস্য করা বলতে গেলে অসম্ভব।

আবার অর্থনীতির বিষয়টি সামনে এসে ভারত যে দাবী করছে, একই দাবী করছে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। তারও নিজেদের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দাবি করে। তাদের দাবিই বরং ভারতের দাবির চেয়ে বেশি শক্তিশালী। কারণ, তারা যুক্তি হিসেবে বলছে, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশ হতে কোন দেশই স্থায়ী সদস্য না, অতএব জাতিসংঘে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের জন্য তাদের দাবী যুক্তিযুক্ত।

অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে জার্মানিও একই দাবী করে। তারা ইউরোপের সুপারপাওয়ার যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। এছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তেই জার্মানির গ্রহণযোগ্যতা আছে।

জার্মানি এবং তুরস্কাও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে চায়-durantobd.com

জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল (বামে), তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান

এরমধ্যে তুরস্ক একটু অন্যভাবে স্থায়ী সদস্যপদ চায়। তাদের দাবী হলো তুরস্কের বৃহৎ অর্থনীতি, সামরিক বাহিনী এবং গণতন্ত্র তো রয়েছেই, সর্বোপরি তারা মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধি হতে চায়। পৃথিবীতে এতগুলা মুসলিম দেশ থাকার পরেও জাতিসংঘের স্থায়ী সদ্যদের মধ্যে কোনো মুসলিম দেশ নেই। তাই তুরস্কের এই দাবীর পেছনেও শক্ত অবস্থান আছে।

উপরের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ দেয়া হলে আগে যোগ্য অনেকগুলো দেশের দাবি বাতিল করে দিতে হবে। যা প্রায় অসম্ভব।

বর্তমান স্থায়ী সদস্যদেরও সায় থাকতে হবে:

বর্তমানে যে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ রয়েছে তাদের মধ্য থেকে কোনো একটি সদস্যও যদি না চায় তাহলে ভারতের পক্ষে স্থায়ী সদস্য হওয়া একেবারেই অসম্ভব। যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স আগের মতো প্রভাবশালী জায়গায় নেই। তারা হয়তো নিজেদের বাণিজ্যিক এবং স্ট্রাটেজিক সুবিধার জন্য অন্য কাউকে ছাড় দিতে পারে তবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন এখানে নতুন কাউকে ঢুকিয়ে নিজেদের প্রভাব খর্ব করতে চাইবে না নিশ্চয়ই। অতএব ভারতের এই স্বপ্ন পূরণ হওয়া কঠিন। বিশ্বে নতুন করে বড় কোনো ওলট-পালট কিংবা বিশ্বযুদ্ধ না হয় তাহলে ভারতের এই পথ অনেক দীর্ঘ।

চীনকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য থেকে সরানো হতে পারে!

সম্প্রতি লাদাখ সীমান্তে চীনের সঙ্গে সংঘাতের পর ভারতীর টুইটার ব্যাবহারকারীরা একটি বিষয়কে ভাইরাল করে তুলেছেন। সেটি হল- জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ থেকে চীনকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা তুলে ধরেছেন, করোনাভাইরাসের মহামারীকে। তাদের দাবি, চীন করোনভাইরাস তৈরি করে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া এলএসিতে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের আগ্রাসনকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন তারা।

কিন্তু আসলে কি চীনের স্থায়ী সদস্যপদ বাতিল করা সম্ভব?

জাতিসংঘ চার্টারের চ্যাপ্টার ৫ অনুযায়ী, একটি দেশকে তখনই সরানো করা যাবে, যখন নতুন একটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হবে। আর এই সিদ্ধান্ত নেবে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ দেশ এবং অস্থায়ী দশ দেশ। ভারত নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।

লাদাখে চীনের এয়ারবেস, স্যাটেলাইট ছবি-durantobd.com

সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যে এয়ারবেসে শক্তি বাড়ায় চীন। স্যাটেলাইট ইমেজ।

এছাড়া চ্যাপ্টার ১৮ অনুযায়ী, চীনের সদস্যপদ বাতিলের পক্ষে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পড়তে হবে। এই দুইটি চার্টারের সমন্বয়ে চীনকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ থেকে সরানো যেতে পারে।

আর্টিকেল ৬ অনুযায়ী, জাতিসংঘের সকল সদস্য একে অপরের অখণ্ডতার প্রতি সম্মান জানাবে। কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে এই প্রস্তাব লঙ্ঘনের বহুন নজির আছে। শুধু তাই না, চীন নিজেও গণতান্ত্রিক দেশ নয়। সবমিলিয়েই এই প্রস্তাব যদি নিরাপত্তা পরিষদে ও জাতিসংঘে উঠে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই চীনকে কূটনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তা সামলে নেয়ার সক্ষমতা চীনের আছে।

তবে কোনোভাবে যদি চীন নিরাপত্তা পরিষদ থেকে অপসারিত হয়ও তারপরেও সেই জায়গায় ভারতের অন্তর্ভুক্তি কঠিন। কারণ, ভারতের চেয়েও কিছু প্রভাবশালী দেশ এই এলিট ক্লাবে যোগ দিতে আগ্রহী।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ:

১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৬ সালের ১৭ জানুয়ারি লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টারের চার্চ হাউজে প্রথম অধিবেশনে বসে। জাতিসংঘের প্রধান ছয়টি অঙ্গের একটি হল নিরাপত্তা পরিষদ।

নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য:

প্রথম প্রায় বিশ বছর জাতিসংঘের অস্থায়ী সদস্য ছিলো ৬টি দেশ- অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মিশর, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ড এবং পোল্যান্ড। ১৯৬৫ সালে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য সংখ্যা ১০ এ উন্নীত করা হয়। দুই বছরের জন্য সাধারণ পরিষদ কর্তৃক এই দশ সদস্য নির্বাচিত হয়। প্রতি বছর জানুয়ারিতে পাঁচটি দেশকে নির্বাচিত করা হয়। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হওয়ার জন্য সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের প্রয়োজন হয়।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের লোগো-durantobd.com

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতীক

বর্তমানে প্রত্যেক জোড় বছরে আফ্রিকা থেকে দুইটি, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল, পশ্চিম ইউরোপ ও অন্যান্য থেকে একটি দেশ সদস্য নির্বাচিত হয়। আর প্রত্যেক বিজোড় বছরে পশ্চিম ইউরোপ ও অন্যান্য থেকে দুটি, আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে একটি দেশ সদস্য নির্বাচিত হয়।

নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতা ও কাজ:

আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই নিরাপত্তা পরিষদের মূল কাজ। জাতিসংঘের সনদ দ্বারা নিরাপত্তা পরিষদের কাজ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে- আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য হুমকি পরিস্থিতির তদন্ত, কোনো বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায় সুপারিশ, সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি সমুদ্র, আকাশ, ডাক ও রেডিও যোগাযোগ ছিন্ন করা এবং প্রয়োজনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন কর। তবে নিরাপত্তা পরিষদ ঐতিহ্যগতভাবে কেবল সামরিক নিরাপত্তার বিষয়টিই দেখে থাকে।

নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতা:

নিরাপত্তা পরিষদ থেকে জারি করা যেকোনো রেজুলেশন মান্য করা জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশের জন্য বাধ্যতামূলক। শান্তিরক্ষার জন্য কোনো ব্যক্তি দেশ বা সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং পরিষদের রেজুলেশনের মাধ্যমে সামরিক অভিযানও চালাতে পারে।

নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের পরিষদের রেজুলেশন, নতুন সদস্য দেশ অন্তর্ভুক্তি বা মহাসচিব প্রার্থীর নিয়োগে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে।

You may also like

Leave a Comment

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More