পোশাক নিয়ে বাঙালির টানাটানি নতুন নয়। হাজার বছর ধরে বাঙালির পোশাকে পরিবর্তন হয়েছে, এবং সেটা রাজনীতির হাত ধরে।
আমরা যদি আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস লক্ষ করি তাহলে দেখব, পাল আমল থেকেই শুরু করি, পাল আমলে বাংলা অঞ্চলের শাসকরা ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কিন্তু অধিকাংশ মানুষ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এক্ষেত্রে বৌদ্ধের পোশাক, হিন্দু ধর্মীয়দের পোশাকের সাথে মেশেনি। হয়তো কেউ কেউ বৌদ্ধ শাসকদের সুনজরে আসার জন্য বৌদ্ধ সংস্কৃতি পালন বা পোশাক ধারণ করতে পারেন।তবে পোশাকে যে একটা বিরোধ ছিল তা স্পষ্ট।
সেন আমলে এসে দেখব, শাসকরা এসেছেন দক্ষিণ ভারত থেকে, এবং তারা ছিল উচ্চ বর্গীয় ব্রাহ্মণ হিন্দু কিন্তু সাধারণ প্রজারা ছিল নিম্নবর্ণ হিন্দু। তাই পোশাকের ক্ষেত্রে এসময়ও শাসক শ্রেণির সাথে সাধারণ মানুষের খুব একটা যোগাযোগ ছিল না।পোশাকের বিরোধ কিন্তু চলমান।
বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর থেকে মূলত এদেশে রাজনৈতিক ভাবে মুসলমানরা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করে। এর ফলে বাংলায় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষা ও পোশাকের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। কারণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অঞ্চলে পোশাকের পরিবর্তন হয়, মুসলিম শাসকরা যেহেতু আফগান, ইরাক,ইরান, তুরস্ক থেকে আগত সুতরাং তাঁরা ইসলামি ধাঁচের পোশাক পরিধান করেছে এটাই স্বাভাবিক।তাদের পোশাক তারা পরেছে, তাতে সমস্যা নেই কিন্তু তার একটা প্রভাব বাঙালি সমাজকেও আলোড়িত করেছে। তাছাড়া ঐ সময় বা তারও আগে থেকে বাংলা অঞ্চলে অনেক নিম্নবর্গীয় হিন্দু বা অন্য জাতিগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে, এবং তাদের পোশাকের ক্ষেত্রে কিন্তু একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। ইসলামে দীক্ষিত বাঙালিরা না পেরেছে পূর্বের পোশাক পুরোপুরি ছাড়তে, না পেরেছে সাচ্চা ইসলামি পোশাকে আবৃত হতে। এক্ষেত্রে বাঙালির যে পোশাক, তাতে দ্বিধাবিভক্তি শুরু হয়েছে নিশ্চিতভাবে।
ইংরেজ আসার পর পোশাকে আবার আরেক ধাক্কা লাগে, সাহেবি পোশাক হিন্দু, মুসলিম উভয় পক্ষকে আকৃষ্ট করতে থাকে। তাদের কেউ কেউ চাকরি সুবাদে হোক আর ইচ্ছে করে হোক সাহেবি পোশাকে অভ্যস্ত হতে থাকে, এক্ষেত্রে ধর্মের চেয়ে চাকরি বা নতুন সাহেবিয়ানা বেশ আকৃষ্ট করেছে এক শ্রেণির বাঙালি হিন্দু বা মুসলিমকে। সেক্ষেত্রে পোশাকে কিন্তু কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। এক্ষেত্রে ধর্ম, সংস্কৃতি, চাকরি, নতুনত্ব, পোশাককে ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। ধরেন নব্য ইংরেজদের সাথে মিশছে এমন একজন নিম্নবর্ণের হিন্দু যিনি বা যার পূর্ব পুরুষ কিছুকাল পূর্বে মুসলিম হয়েছে, তাহলে তার পোশাক কেমন হবে? তিনি হয়তো কোর্ট পরছেন, তার স্ত্রী হয়তো শাড়ি বা বোরকা , মেয়েরা হয়তো শালোয়ার বা স্কার্ট পরছেন অর্থাৎ হ য ব র ল।
আবার ইংরেজ বিদেয় হওয়ার পর আমরা ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান হলাম, সেখানে এসে আমাদের পোশাক কী হবে? আমরা নব্য মুসলিম দেশ হয়েছি, আমরা জাতিতে রয়ে গেছি বাঙালি অর্থাৎ পূর্বের সেই বাঙালি, যারা পাল, সেন, সুলতানি, নবাবি, মুঘল, ইংরেজ আমল পার হয়ে এসেছি। এবার যেহেতু মুসলিম দেশ তাই অনিবার্য ভাবেই আমরা মুসলিম পোশাকের দিকে আগের তুলনায় একটু বেশি এলিয়েছি। ধর্মপ্রাণ মুসলিম মেয়েদের অন্যান্য পোশাকের মধ্যে বোরখা হতে থাকে জনপ্রিয়, সেটার শুরু হয়তো আরও অনেক আগে।
ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাঙালি স্বাধীন দেশ লাভ করে এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাও অর্জিত হয়। পোশাক নিয়ে স্বাধীনতার পরে খুব একটা আলোড়ন হয়নি, যে যার মত স্বাধীন পোশাক পছন্দ করেছে। স্কুল, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে শাড়ি, শালোয়ার -কামিজ, বোরখা পাশাপাশি চলেছে। তবে একবিংশ শতকে এসে তথ্য প্রযুক্তি বাঙালিকে আরও এলোমেলো করে দিয়েছে, সেটা যেমন চিন্তা-চেতনায়, তেমনি সংস্কৃতি বা পোশাকেও। কেউ কেউ ধর্মের প্রতি অধিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের জায়গা থেকে ইসলামি পোশাকে তার শালোয়ার, শাড়ি, স্কার্ট, জিন্স ঢেকেছে, আবার আরেক গোষ্ঠী পশ্চিমা ধাঁচের পোশাকে আবৃত হয়েছে।
তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে পোশাকের এই পরিবর্তন খুব বেশি নয়, যতটানা মেয়েদের ক্ষেত্রে হয়েছে।বাংলাদেশে বোরখার প্রচলন পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় বেশি হয়েছে, এটা মুসলিম দেশ তথা মুসলিম সমাজকে আরও সুসংহত করেছে নিঃসন্দেহ। তবে পূর্বে যেমন শুধুই ধর্মীয় চেতনা থেকে বোরখা পরা হতো, বর্তমানে এসে তাতে কিছু প্রশ্ন উঠেছে বোরকার আকার, আকৃতি, রং-চঙ, ব্যবহার বিধি নিয়ে।
যেকোন পোশাকের আলোচনা, সমালোনা পূর্বেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে, পরেও হবে। এর প্রধান কারণ আমাদের ঐতিহাসিক মিশ্রণ ও নিজস্বতার অভাব।

লেখক: সেলিম রেজা, প্রভাষক -বাংলা,গোল-ই-আফরোজ সরকারি কলেজ, নাটোর
।