দেশের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে ঝিনাইদহ জেলার মানুষ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় এ জেলায় যারা আত্মহত্যা করেন তাদের বেশিরভাগ অল্প বয়সী এবং নারী। কিন্তু ঝিনাইদহে কেন এত আত্মহত্যা সংঘটিত হয়?
ঝিনাইদহের স্থানীয় কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী ও বেসরকারি সংস্থা আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করে। এদের মধ্যে সোসাইটি ফর ভলান্টারি অ্যাকটিভিটিজ-সোভা অন্যতম।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেনে, ঝিনাইদহে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪শ’র মত মানুষ আত্মহত্যা করেন।
২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঝিনাইদহে ৩ হাজার ১৫২ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে ২২ হাজার ৬৭৫ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ঝিনাইদহে ১২০ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, গত এক দশক ধরে এই জেলায় দিনে গড়ে একজন করে মানুষ আত্মহত্যা করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যা করেন। প্রতি লাখে মৃত্যুর হার ১৬ জন।
স্থানীয় গবেষণার বরাতে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৬ থেকে ১০ জন, যা উন্নত দেশের কাছাকাছি।
সোভার প্রধান নির্বাহী জাহিদুল ইসলাম জানান, ঝিনাইদহে এই হার এক লাখে প্রায় ২১ জন।
ঝিনাইদহে কেন এত আত্মহত্যা হয়?
ঝিনাইদহে এত বেশি আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে সরকারি বা ব্যক্তিগত কোন গবেষণার কথা জানা যায়নি।
ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম জানিয়েছেন, জেলায় আত্মহত্যা করা মানুষের বড় অংশটি নারী এবং অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে। ঝিনাইদহের মধ্যে শৈলকূপা উপজেলায় আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে।
আরো পড়ুন: গায়ে আগুন লাগলে করণীয়
এত বেশি মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়ার কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. সেলিনা বেগম বলেন, কোন সার্ভে তো নাই আমাদের, কিন্তু কাজ করার অভিজ্ঞতায় যা বুঝি তা হলো পারিবারিক কলহের ঘটনা এখানে অনেক বেশি। তাছাড়া পারিবারিক পর্যায়ে ছোটখাটো মান-অভিমানের কারণেও আত্মহত্যা করে বসে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা।
তবে সোভার প্রধান নির্বাহী জাহিদুল ইসলাম এর পেছনে ভিন্ন কিছু কারণের কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, দক্ষিণ অঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে ঝিনাইদহে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক কম, এমনকি সিডর বা আইলাতেও তেমন ক্ষতি হয়নি এই জেলায়। এর মানে হচ্ছে, এখানে জীবনের জটিলতা কম। যে কারণে মানুষ অনেক বেশি আবেগপ্রবণ এবং আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ কম।
তার মতে, এই কারণে ঝিনাইদহে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
ঝিনাইদহে আত্মহত্যার হার কেন বেশি, তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার।
তিনি বলেন, এর পেছনে ভৌগোলিক, জলবায়ুগত, জেনেটিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কারণ কোনটি কাজ করেছে সেটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দরকার।
তার কথায়, সাধারণত আত্মহননের পেছনে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
আরো পড়ুন:
প্রেমে বেশি চিটিং করে ছেলেরা নাকি মেয়েরা?
যেসব ভুল আপনার সঙ্গীকে পরকীয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে!
মেখলা সরকার বলেন, কারো জিনের মধ্যে হতাশা বা মানসিক অস্থিরতার বিষয়টি থাকতে পারে। আবার একজন মানুষের বেড়ে ওঠার সময় তার পরিবারে বা চারপাশে আত্মহত্যার উদাহরণ থাকা- এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিকার কী?
সামগ্রিকভাবে আত্মহত্যা ঠেকাতে পরিবার এবং সমাজকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, পরিবারগুলোকে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে, তবে পরিবারকেও নিজেদের আচরণ এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
এক্ষেত্রে তিনি কিছু পদক্ষেপের কথা বলেছেন:
** পরিবারের ছোটদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে, তাদের বুঝতে হবে।
** সন্তানদের খেলাধুলা এবং সামাজিক মেলামেশার সুযোগ বাড়াতে হবে।
** পড়াশোনা, খেলাধুলা নিয়ে সন্তানদের চাপ প্রয়োগ না করা। তাদের চাপ মোকাবেলা করতে শেখানো।
** ব্যর্থতা মেনে নেয়া নিজেদেরও শিখতে হবে, বাচ্চাকেও শেখাতে হবে।
** মনে আঘাত দিয়ে সবসময় সমালোচনা না করা। সমবয়সীদের সঙ্গে তুলনা না করা।