তৈমুর লং এর অভিশাপ এবং জার্মানির সোভিয়েত আক্রমণ
পুরো নাম তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস। তিনি ছিলেন মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিস খানের বংশধর। পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ সাম্রাজ্য দখল করে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ যার মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, পাকিস্তান, ভারত এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত তৈমুর লংয়ের অধীনস্ত ছিল। ১৪০৫ সালে কাজাখাস্তানে প্রচন্ড শীতের দাপটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তৈমুরকে তার ঘাঁটি সমরকান্দের গোর-এ-আমির এ সমাহিত করা হয়।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্টালিনের আদেশে তৈমুরের মুখায়ব উদ্ধারের জন্য একদল ভূতত্ত্ববিদ আসেন উজবেকিস্তানের সমরকন্দে। কবর খনন করে তারা তৈমুরের দেহাবশেষ বের করে আনেন। তৈমুরের কবরের এক পাশে লেখা ছিল ‘আমার নিদ্রায় ব্যাঘাত করো না, নিদ্রাভঙ্গ হলে পৃথিবীতে সর্বনাশা যুদ্ধ শুরু হবে।’
এর মাত্র তিনদিন পর সোভিয়েন ইউনিয়ন হামলা করে হিটলারের জার্মানি। হিটলারের বাহিনীর আক্রমণে মাত্র দুদিনে ২৬ লাখ সোভিয়েত নাগরিক প্রাণ হারান। এক পর্যায়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে সোভিয়েতরা। কয়েক মাস পর আবার তৈমুর লংকে সমাহিত করা হয়। কাকতালীয়ভাবে কয়েকদিন পরই স্ট্যালিনগ্রাদে আত্মসমর্পণ করে জার্মানবাহিনী।
প্রথম দেশ হিসেবে পারমানবিক অস্ত্র ধ্বংস
৭০’র দশক। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে বড় বড় দেশগুলো নিজেদের অস্ত্রের মজুত দেখাতে ব্যস্ত। যার যতো বেশি অস্ত্র সে দেশ ততো বেশি শক্তিশালী। শক্তির এই দাপটের খেলায় যোগ দিল দক্ষিণ আফ্রিকাও। বর্ণবাদী আন্দোলনের ডামাডোলের মধ্যেই দেশটি তৈরি করে ফেলল পারমানবিক অস্ত্র। পাশ্চাত্যের দেশগুলো প্রোটিয়াদের হাতে পারমানবিক অস্ত্র কিছুটা বোধ হয় বিচলিতই হলো। পশ্চিমা বিশ্বে তখন রাজনৈতিক টানাপোড়ন। এরই মধ্যে ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট এফ.ডব্লিউ ডি ক্লার্ক ঘোষণা দিলেন, তার দেশ পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করেছে এবং সফলও হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার পারমানবিক অস্ত্র তৈরির সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়ল পাশ্ববর্তী দেশগুলোও। শুরু হলো কুটনৈতিক তৎপরতা। প্রতিবেশি দেশসহ রাশিয়া, আমেরিকা চাপ প্রয়োগ করা শুরু করল দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পারমানবিক অস্ত্র ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেয় দেশটি। একপর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করে। এই কারণে নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন ডি ক্লার্ক।
ইতিহাসের প্রথম দেশ হিসেবে পারমানবিক অস্ত্র ধ্বংস করে এনটিপির পক্ষরাষ্ট্রে পরিণত হয় আফ্রিকান দেশটি।
কার্নেশন বিপ্লব
রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের রচনা করে পৃথিবীর ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে পর্তুগাল। ১৯১০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। প্রজাতন্ত্র এলেও পর্তুগালের জনগণ যে খুব একটা সুখে ছিল সেটা বলা যাবে না। গণতন্ত্রের উদ্ভব হলেও অস্থিতিশীলতার কারণে নানা সংকটের মধ্য দিকে যায় দেশটি। শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। ১৯২৬ সালে সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে দেশটিতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুরুর বছরগুলিতে সবকিছু মোটামুটি চললেও একনায়কতন্ত্র মেনে নিতে পারছিলেন না অনেকে। সরকার বিরোধীদের কণ্ঠস্বর রোধ করা হতো প্রকাশ্যে। দেশটির অর্থনীতিতেও নেমে আসে বিপর্যয়। এর ফলে ১৯৭৪ সালে সামরিক বাহিনীর সংঘবদ্ধ একটি অংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আন্দোলন প্রকাশ্য হতেই জনগণ বিপুলভাবে আন্দোলনকে সমর্থন দিতে থাকেন। এর ফলে কোনো ধরনের খুনোখুনি ছাড়াই বদল আসে পর্তুগালে।
পাঁচ দশক ধরে চলা একনায়কতন্ত্রের অবসান হয় ২৫ এপ্রিল ১৯৭৪ সালে। এদিন বন্দুকের নলের মধ্যে কার্নেশন ফুল ভরে রাস্তায় নেমে পড়েন। সেদিন ফুল হাতে তাদের সমর্থন জানান দেশটির লাখো জনগণ। ফুল দিয়েই সেদিন একনায়কতান্ত্রিক সাম্রাজের ভিত উপড়ে ফেলে দেশটির মুক্তিকামী মানুষ।
ব্ল্যাক অক্টোবর
সংকটের শুরুটা হয় সেপ্টেম্বরই। ততোদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। রাশিয়া জুড়ে তখন কেবল অস্থিরতা। সেবার সেপ্টেম্বর থেকেই রাশিয়াতে গরম পড়তে শুরু করেছে। রাজনীতির মাঠ আরো গরম। রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিন। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সংঘর্ষ। প্রেসিডেন্ট বনাম পার্লামেন্ট। দেশটির সুপ্রিম কোর্টের রচিত সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খর্ব করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সরাসরি সেটি নাকচ করে দিলেন ইয়েলেৎসিন। বিকল্প সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব রাখলেন তিনি। প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব পাশ হলো না। সংকটের মুখে ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ এবং ‘সুপ্রিম কাউন্সিল’, দুই স্তরের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়েলেৎসিন।
ইয়েলেৎসিনকে অভিসংশনের প্রস্তাব আনা হয়। দেশে জুড়ে ইয়েলেৎসিন বিরোধীরা আন্দোলন শুরু করে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কঠোর হস্তে আন্দোলন দমন করতে থাকে। তবে ফল হয় উল্টো। মস্কোর মেয়রের অফিস ও স্থানীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। দেশ জুড়ে জরুরী অবস্থা জারি করেন ইয়েলেৎসিন। ২ অক্টোবর মস্কোর রাজপথ দখল করে নেন আন্দোলনকারীরা। পরের দিন দেশটির পার্লামেন্ট ভবন হোয়াইট হাউস দখল করে তারা।
৪ অক্টোবর সেনাবাহিনীকে যে কোনো মূল্যে আন্দোলনকারীদের নিবৃত্ত করার আদেশ দেন ইয়েলেৎসিন। মাত্র কয়েক ঘন্টার অভিযানে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়। সেদিন ১৮৭ জন মানুষ নিহত নয়, বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা দুই হাজারেরও বেশি। তিন মাস পর, ১২ ডিসেম্বর ইয়েলেৎসিনের তৈরি করা সংবিধান পাশ হয়। সেদিনই ‘কনস্টিটিউশন অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন’ এর যাত্রা শুরু হয়।
জম্বিদের হামলা
জম্বি নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। হলিউড, বলিউডে হাজারো সিনেমা নির্মিত হয়েছে এই জম্বিদের নিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা নিয়ে মানুষের তুমুল কৌতুহল রয়েছে। ধারণা করা হয় জম্বিদের নিয়ে তৈরি সিনেমার এটিই অন্যতম অনুপ্রেরণা। ঘটনাটি ঘটে বর্তমান পোল্যান্ডের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত “অসউইক দূর্গে”। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্গটি ছিল রাশিয়ার দখলে। ১৯১৪ ও ১৯১৫ সালে দুবার জার্মানরা এই দুর্গের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য তুমুল আক্রমণ চালায়। তবে একটি আক্রমণও সফল হয়নি।
তবে ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বরে অসউইক দূর্গে আবার হামলা চালায় জার্মানি। এবার প্রথমাগত অস্ত্রের বাইরে তাদের হাতে ছিল ক্লোরিন ও ব্রোমিনের সমন্বয়ে গঠিত নতুন গ্যাস অস্ত্র। এই গ্যাস মানুষের শরীরের প্রবেশ করলে কয়েক মিনেটের মধ্যে মৃত্যু অবধারিত। জার্মানদের নতুন এই মারনাস্ত্র সম্পর্কে একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিল না রাশিয়ানরা।
গ্যাস ছাড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে জায়গায় দাঁড়িয়েই মৃত্যুবরণ করতে থাকে রাশিয়ান সৈনিকরা। শরীর পুড়ে যেতে থাকে, অনেকের মাংস খুলে যাওয়া শুরু করে। জার্মানরা ভাবলো আর কেউ হয়তো বেচে নেই। যখনই তারা দূর্গ দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক তখনই শখানেক রাশিয়ান সৈনিক গুলি বর্ষণ শুরু করে। অনেকের মাথার ঘিলুর অর্ধেকরা নেই তো কারো শরীরের নিচটা খুলে গেছে। পাগলের মতো তারা ছুটতে শুরু করে জার্মানদের উদ্দেশ্যে। জার্মানরা এই দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা ভাবলো, মৃত মানুষরা জীবিত হয়ে তাদের ওপর হামলা করেছে। ভয়ে অসউইক ছাড়ে শত্রুপক্ষ। ইতিহাসে এই ঘটনা দ্য অ্যাটাক অফ দ্য ডেড ম্যান নামে অমর হয়ে আছে।