ফাহিম সালেহ প্রযুক্তিবিষয়ক একজন তরুণ উদ্যোক্তা ছিলেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি প্রযুক্তি বিষয়ক নানা উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক সফলতা পেয়েছিলেন।
নিউইয়র্কের যে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ফাহিম সালেহ খুন হয়েছেন এর মালিক ছিলেন তিনি নিজেই।
ব্রিটেনের ডেইলিমেইল অনলাইনের খবরে ফাহিম সালেহকে একজন মিলিয়নিয়র প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোক্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান, সৌদিতে জন্ম, নিইউয়র্কে বেড়ে ওঠা ফাহিম সালেহ’র
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা বলছে, ফাহিম সালেহ’র জন্ম সৌদি আরবে, ১৯৮৬ সালে। এরপর পরিবারের সঙ্গ তিনি নিউইয়র্কে চলে যানে।
ফাহিম সালেহ বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান হলেও বাংলাদেশে খুব একটা থাকেননি।
ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৯ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন ফাহিম। তিনি নিউইয়র্কেই বসবাস করতেন।
জানা গেছে, ফাহিমের বাবাও ছিলেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের হরিশপুর গ্রামের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সালাহউদ্দিন আহমেদ বিশ্বখ্যাত আইবিএম কর্পোরেশনের এডভাইজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি করতেন।
আইবিএম থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন নিউইয়র্ক থেকে দেড়শ’ কিলোমিটার উত্তরের ডাচেস কাউন্টির ফুকেটসি এলাকায়।
স্ত্রী রায়হানা, দুই কন্যা এ্যাঞ্জেলা ও রুবি এবং একমাত্র পুত্র ফাহিম সালেহকে নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদের ছিলো সুখী সংসার।
৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছরই উদ্যোক্তা ছিলেন ফাহিম সালেহ
ফাহিম সালেহ পেশায় একজন ওয়েবসাইট ডেভেলপার ছিলেন।
মাত্র ৩৩-বছর বয়সে যে অ্যাপার্টমেন্টে তিনি নৃশংসভাবে খুন হন, তার দাম বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২২ কোটি টাকা। এটি নিজের অর্থেই কিনেছিলেন তিনি।
মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে আমেরিকাতে আইটি ফিল্ডে কাজ শুরু করেছিলেন ফাহিম।
২০১৪ সালে তিনি ঢাকায় এসে প্রযুক্তিভিত্তিক কিছু ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরমধ্যে ‘পাঠাও’ সার্ভিস অন্যতম। তার উদ্যোগগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়েছিলো। এরমধ্যে পাঠাও উদ্যোগ সফল হয়। শুরুতে পণ্য পরিবহন করলেও পরে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চালু করে পাঠাও।
পাঠাও প্রতিষ্ঠার সময় ফাহিম সালেহর সঙ্গে আরো দুজন ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার কিছু শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে নিউইয়র্কে চলে আসেন।
এরপর তিনি পাঠাওয়ের আদলে অন্যদেশে ব্যবসার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে নাইজেরিয়ায় গোকাডা চালু করেন।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই সংকটে পড়ে তারা। কারণ, নাইজেরিয়ার সরকার মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং নিষিদ্ধ করে। তবে সংকটে পড়ার আগে এক বছরেই গোকাডা ৫৩ লাখ ডলার বা ৪০ কোটির বেশি টাকা আয় করে। যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ হয়ে গেলে গোকাডা পার্সেল ডেলিভারি সার্ভিস চালু করে।
ঢাকায় বেশিরভাগ উদ্যোগই ব্যর্থ হয় ফাহিম সালেহর
পাঠাও প্রতিষ্ঠার আগেই ফাহিম সালেহ ঢাকায় দু’টি প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন, যার মধ্যে একটি ছিলো হ্যাকহাউজ। এর অফিস ছিলো বনানীতে।
এখানেই কাজ করার সময়ই হুসেইন ইলিয়াসের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তারা দু’জনসহ মোট তিনজন মিলে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও চালুর কাজ শুরু করেন।
আগের দু’টি উদ্যোগে তেমন সাফল্য না আসলেও ২০১৬ সালের শেষের দিকে চালুর পর পাঠাও দারুণ জনপ্রিয়তা পায় ২০১৭ সালে।
‘পাঠাও’ নামের যে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়, তার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন ফাহিম সালেহ। আরেকজন হলেন হুসেইন এম ইলিয়াস।
হুসেইন এম ইলিয়াস বলছিলেন, সত্যিকার অর্থেই একজন স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন ফাহিম সালেহ।
ইলিয়াস বিবিসি বাংলাকে বলেন, খুব কম মানুষই এতো তাড়াতাড়ি কিংবা এতো অল্প বয়সে সফল হয়েছেন। এর কারণ হলো তিনি খুবই উদ্যমী ও পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। এক জায়গায় আটকে থাকতেন না তিনি। এজন্যই একটার পর একটা উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনটায় সফল হয়েছেন, আবার কোনটায় হননি। কিন্তু হাল ছাড়েননি।
ঢাকায় আসলে একাই বাসা ভাড়া করে থাকতেন ফাহিম সালেহ। ঢাকায় কী করছেন তা দেখাতে ২০১৮ সালের বাবা-মাকেও একবার নিয়ে এসেছিলেন আমেরিকা থেকে।
তবে বাংলাদেশে পাঠাওয়ের শেয়ার বিক্রি করে দিলেও অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জোবাইক ও যাত্রীতে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। বিনিয়োগ ছিলো আলফাপটেটো নামের আরেকটি উদ্যোগেও।
নেপালের অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্লাটফরমেও বিনিয়োগ ছিল ফাহিম সালেহ’র।
কলম্বিয়াতে সবচেয়ে বড় মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পিকাপ-এও বড় ধরণের বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি।
স্বপ্নবাজ ফাহিম সালেহ
ফাহিম সালেহ নিজের সম্পর্কে ওয়েবসাইটে লিখেছিলেন অন্ট্রেপ্রেনিওর, ইনভেস্টর, ড্রিমার অর্থাৎ উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, স্বপ্নবাজ।
বিভিন্ন দেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কিংবা ওয়েবসাইট নেটওয়ার্কিং ছাড়াও তার ব্লগে যেসব প্রজেক্টের কথা তিনি উল্লেখ করেছন, সেগুলো হলো- প্রাংকডায়াল (এর মাধ্যমে বন্ধুদের কাছে ফানি কল পাঠানো হয়), ডলস্পট (বাচ্চাদের মোবাইল-ভিত্তিক গেমিং সাইট) এবং হ্যাকহাউজ (ঢাকা-ভিত্তিক উদ্যোগ)। আরও বিনিয়োগ ছিল নিনজা ফিস স্টুডিওস-এ। এটি বাচ্চাদের মোবাইল গেমিং কোম্পানি।
নিজের ব্লগে ফাহিম সালেহ লিখেছিলেন, ডোন্ট ফলো দা মানি, লেট ইট ফলো ইউ। অর্থাৎ অর্থকে অনুসরণ করোনা, তাকেই তোমাকে অনুসরণ করতে দাও।
নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যা জানা গেল
গত ১৪ জুলাই নিউইয়র্কের নিজ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও’য়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
একদিন পর জানা যায় ফাহিমের মৃতদেহকে বুকের মাঝ বরাবর কেটে খণ্ডিত করা হয়েছে।
পুলিশের ধারণা, লাশ ব্যাগে ভরার উদ্দেশেই কাটা হয়েছিল, তবে পরে কেউ চলে আসায় তা আর সম্ভব হয়নি।
ফাহিমের পেশাদার ঘাতক সোমবার (১৩ জুলাই) বিকেলে লিফটে ফাহিমের সাথেই সপ্তম তলায় ওঠে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, লোকটি কালো পোশাক পরিহিত ছিল। মাথায় টুপি, মাস্ক-সবকিছু ছিল কালো। হাতে ছিল বড় একটি স্যুটকেস। পুলিশের ধারণা, অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ফাহিমকে হয়তো মাথায় আঘাত করে দুর্বল করা হয় এরপরই বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে গলা কাটা হয়। পাশাপাশি দু’হাত ও দু’পা কাটা হয়। বুকের মধ্যেখানেও করাত চালিয়ে দ্বিখণ্ডিত করা হয়।
এরপর খণ্ড খণ্ড অংশ আলাদা পলিথিন ব্যাগে ভরা হয়। ফ্লোরের রক্ত মুছে ফেলা হয় কৌশলে। করাতেও ছিল না রক্তের দাগ।
তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা, ফাহিমকে হত্যার পর হয়তো টুকরো টুকরো লাশ ঐ স্যুটকেসে ভরে কোথাও নেয়া হতো।
তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা, খণ্ড খণ্ড লাশ স্যুটকেসে ভরার আগেই হয়তো ওই এপার্টমেন্টে আসতে আগ্রহী কেউ নিচে থেকে কলিং বেল টিপেছিলেন। সে শব্দেই ঘাতক সবকিছু ফেলে পালিয়েছে।
পলিথিনে লাশ দেখে আঁতকে উঠেন তার বোন
এর আগে সোমবার বিকেলে ১০ তলার ওই ভবনের সপ্তম তলায় নিজ এপার্টমেন্টে ফেরেন ফাহিম।
এরপর সারারাত এবং পরদিন (১৪ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত চেষ্টা করেও ফাহিমকে ফোনে না পেয়ে তার খালাতো বোন ছুটে আসেন ওই ভবনে। এরপর এপার্টমেন্টে গিয়ে আঁতকে উঠেন ফাহিমের খণ্ড-বিখণ্ড লাশ পলিথিন ব্যাগে দেখে। সাথে সাথে ফোন করেন ফাহিমের ছোটবোন রিফ-সালেহকে। দ্রুত চলে আসেন তিনি। এরইমধ্যে ৯১১ এ কল করা হয়।
এছাড়া লিফটের একটি নজরদারি ক্যামেরায় ফাহিমের গতিবিধির কিছু ফুটেজ পাওয়া গেছে। তাতে সবশেষ সোমবার তাকে লিফটের ভেতর দেখা গেছে। স্যুট, গ্লভস, হ্যাট এবং মাস্ক পরিহিত একটি লোককে ওই সময় তাকে অনুসরণ করতে দেখা যাচ্ছে।
পুলিশের ধারণা, ফাহিম লিফট থেকে বের হওয়ার পরপরই তাকে গুলি করা হয়েছে অথবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে।
আরো পড়ুন:
বিশ্বের আলোচিত সরকার প্রধানদের কার বেতন কত?
বিশ্বের ৭ ধর্মহীন দেশ, সৃষ্টিকর্তা নিয়ে যা ভাবেন তারা
কোন কাজেই বাধা নেই আজব এ জেলখানায়! (ভিডিও)
যেভাবে তৈরি করা হচ্ছে করোনার ভ্যাকসিন
বিশ্বের প্রথম স্বর্ণের হোটেল, এক রাতের ভাড়া কত?
চীনকে সরিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে ভারতের যা দরকার